সমস্ত লেখাগুলি

বাঙালির মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার (সংক্ষেপিত) -
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়
Nov. 20, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:812 | likes:0 | share: 0 | comments:0

দ্বিতীয় সাহিত্য সম্মিলনীর অভিভাষণে এক স্থলে বলিয়াছিলাম যে, ‘প্রায় সহস্র বৎসর যাবৎ হিন্দুজাতি একপ্রকার মৃতপ্রায় হইয়া রহিয়াছে। যেমন ধনীর সন্তান পৈতৃক বিভব হারাইয়া নিঃস্বভাবে কালাতিপাত করেন, অথচ পূর্বপুরুষগণের ঐশ্বর্যের দোহাই দিয়া গর্বে স্ফীত হন। আমাদেরও দশা সেইরূপ। লেকী বলেন যে, খৃঃ অঃ দ্বাদশ শতাব্দী হইতে ইউরোপ খণ্ডে স্বাধীন চিন্তার স্রোত প্রথম প্রবাহিত হয়। প্রায় সেই সময় হইতেই ভারতগগন তিমিরাচ্ছন্ন হইল। অধ্যাপক বেবর (Weber) যথার্থই বলিয়াছেন যে, ভাস্করাচার্য ভারতগগনের শেষ নক্ষত্র। সত্য বটে, আমরা নব্য স্মৃতি ও নব্য ন্যায়ের দোহাই দিয়া বাঙালি মস্তিষ্কের প্রখরতার শ্লাঘা করিয়া থাকি, কিন্তু ইহা আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে যে, যে সময় স্মার্ত ভট্টাচার্য মহাশয় মনু, যাজ্ঞবল্ক, পরাশর প্রভৃতি মন্থন ও আলোড়ন করিয়া নবম বর্ষীয়া বিধবা নির্জলা উপবাস না করিলে তাহার পিতৃ ও মাতৃকুলের ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন কয় পুরুষ নিরয়গামী হইবেন, ইত্যাকার গবেষণায় নিযুক্ত ছিলেন, যে সময়ে রঘুনাথ, গদাধর ও জগদীশ প্রভৃতি মহামহোপাধ্যায়গণ বিবিধ জটিল টীকা-টিপ্পনী রচনা করিয়া টোলের ছাত্রদিগের আতঙ্ক উৎপাদন করিতেছিলেন, যে সময়ে এখানকার জ্যোতির্বিদগণ প্রাতে দুই দণ্ড দশপল গতে নৈঋত কোণে বায়স কা কা রব করিলে সে দিন কী প্রকারে যাইবে ইত্যাদি বিষয় নির্ণয়পূর্বক কাকচরিত্র রচনা করিতেছিলেন, যে সময়ে এ দেশের অধ্যাপকমণ্ডলী ‘তাল পড়িয়া ঢিপ করে, কি ঢিপ করিয়া তাল পড়ে’ ইত্যাকার তর্কের মীমাংসায় সভাস্থলে ভীতি উৎপাদন করিয়া সমবেত জনগণের অন্তরে শান্তিভঙ্গের আয়োজন করিতেছিলেন, সেই সময়ে ইউরোপে গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন প্রমুখ মনস্বীগণ উদীয়মান প্রকৃতির নূতন নূতন তত্ত্ব উদ্ঘাটন পূর্বক জ্ঞান জগতে যুগান্তর উপস্থিত করিতেছিলেন ও মানবজীবনের সার্থকতা সম্পাদন করিতেছিলেন। 

উপরে যে মন্তব্য প্রকটিত হইল, তাহা একবার বিশেষভাবে আলোচনা করিয়া দেখা যাউক। বিশেষত বঙ্কিমচন্দ্র এক স্থলে স্মরণীয় বাঙালির মধ্যে উল্লিখিত মহাত্মাগণ ও কুল্লুকভট্টের নাম করিয়া বলিয়াছেন, ‘অবনতাবস্থায়ও বঙ্গমাতা রত্নপ্রসবিণী'। এখন বিবেচনার বিষয় এই যে, আজ বর্তমান জগতের ভীষণ জীবনসংঘর্ষের দিনে আপনাদের জাতীয় অস্তিত্ব বজায় রাখিতে হইলে রঘুনন্দন ও কুল্লুকভট্টের টোলে প্রবেশ লাভ করিয়া পুনরায় ন্যায় সাংখ্যের গবেষণায় নিযুক্ত হইতে হইবে, কি বিংশ শতাব্দীর জ্ঞান ও প্রতিভার রশ্মি লক্ষ্য করিয়া ধাবিত হইতে হইবে? আমরা আজ কালবারিধিতীরে দাঁড়াইয়া শুধু কি উত্তাল তরঙ্গমালা গনিয়া হতাশ মনে গৃহে ফিরিব? ক্ষুদ্র জলাশয়ে আবদ্ধ হইয়া ভাবিব, আমরা বেশ আছি? অথবা নিরাশার তীব্র দংশনের ক্ষোভ মিটাইবার নিমিত্ত ভাবিব, বর্তমান জগতের শিক্ষা ও দীক্ষা ভ্রান্তিমূলক, উহা মানব হৃদয়ে জ্বালাময়ী তৃষ্ণা জনন করিয়া সুখ, শাস্তি ও আধ্যাত্মিক চিন্তাশীলতার পথে কণ্টকসমাকীর্ণ করে?

কোনো জাতির গৌরব ও মহত্ব নিরূপণ করিতে হইলে, কী কী উপাদানে এই মহত্ব গঠিত সর্বাগ্রে তাহারই পর্যালোচনা করিতে হইবে। আমার বোধ হয়, ভূদেব ও বঙ্কিমচন্দ্রের লিখিত অভিমতের উপর নির্ভর করিয়া যাঁহারা বাঙালির, এমনকী হিন্দু জাতির অতীত গৌরবের শ্লাঘা করিয়া থাকেন, তাঁহারা অজ্ঞাতসারে ভ্রান্ত অভিমত পোষণ করেন মাত্র। রঘুনন্দন ও কুল্লুকভট্টের টীকা-টিপ্পনী শ্লাঘার বিষয় জ্ঞান করিয়া, যদি উহারই আদেশ অভ্রান্ত সত্য মানিয়া, সেই অতীতপ্রায় কূটশিক্ষায় মনোনিবেশ আমাদের গৌরবের বিষয় বলিয়া অনুমিত হয়, আর বর্তমানের নূতন আশা, নুতন উদ্দীপন ঠেলিয়া ফেলিয়া প্রাচীনের প্রচলন স্থির ধীর কর্ম বলিয়া আদৃত হয়, জানি না এ মৃতপ্রায় জাতি নূতনের প্রবল অসহনীয় সংঘর্ষে আর কতদিন বাঁচিতে সক্ষম হইবে। স্বাধীন চিন্তা জাতীয় জীবননদের উৎস। এই উৎস যেদিন হইতে শুকাইতে আরম্ভ করিয়াছে, সেই দিন হইতে মৌলিকতা ও অনুসন্ধিৎসা তিরোহিত হইয়াছে, সেই দিন হইতে বাঙালি জাতির অধোগতির সূত্রপাত হইয়াছে। আজ সহস্র বৎসরকাল এই স্বাধীন চিন্তার স্রোত আলস্য এবং অন্ধবিশ্বাসরূপ গভীর কর্দমে আবদ্ধ হইয়া জাতীয় জীবনের প্রস্রবণকে বদ্ধ করিয়াছে। যখনই স্বাধীন চিন্তা, বিচার শক্তি ইত্যাদির হ্রাস হইয়া আইসে, চরিত্র মধ্যে যখন স্বীয় অভিমত পোষণ করিবার সাহস চলিয়া যায়, তখন পরের গ্রাসে আহার করিবার প্রবৃত্তি বাড়িয়া উঠে। ফলত এরূপ জীবন ইতর প্রাণীর জীবনাপেক্ষা অল্পমাত্রই বিভিন্ন, কেন না, প্রাকৃতিক আদেশ প্রতিপালনই মানুষের একমাত্র লক্ষ্যের বিষয় নহে। গাভী প্রত্যুষ হইতে প্রদোষ পর্যন্ত ঘাস খায়, ক্লান্ত হইয়া রাত্রে বিশ্রাম করে, দিবসভুক্ত নবতৃণাঙ্কুর উদ্গীরণ ও রোমন্থন করে— স্বীয় বৎসকে স্তন্য দেয় ও যথাসম্ভব তাহাকে মানুষের অত্যাচার হইতে রক্ষা করিবার প্রয়াস পায়; পরম স্নেহাস্পদ বৎসটির গাত্র স্নেহনিদর্শনস্বরূপ অবলেহন করে। এই প্রকার জীবনযাত্রা নির্বাহ করাই কি মানবের উদ্দেশ্য? আহার-বিহার-নিদ্রাই কি ঈশ্বরসৃষ্ট শ্রেষ্ঠ জীবের কেবল একমাত্র কর্তব্য? আপনার গণ্ডির ভিতর আবদ্ধ থাকিয়া নিষ্ফল সস্বার্থ- গবেষণায় কালাতিপাত করা, জাত্যাভিমান পাণ্ডিত্যাভিমানে স্ফীত হইয়া উচ্চ-নীচের কল্পিত ভেদাভেদকে গভীরতর করা, আর মানবজাতির সাধারণ সম্পত্তি স্বাধীন চিন্তাকে বিসর্জন দিয়া, দুর্বোধ শ্রুতি ও স্মৃতির টীকাকরণে মস্তিস্কের প্রখরতা ক্ষয় করা কি বিধাতার অভিপ্রেত? পরম করুণাময় পরমেশ্বর কি মানুষকে জ্ঞান, ধৃতি, ক্ষমা ইত্যাদি দুর্লভ গুণালংকৃত করিয়াও এতদপেক্ষা মহত্তর চরিত্র ও অনুষ্ঠান দাবি করেন না?

ভারতবর্ষীয় প্রাচীন গৌরবের কথা আমি ভুলি নাই; পূর্বপুরুষগণের পবিত্র স্মৃতির প্রতিও আমি কাহাকেও সম্ভ্রমহীন হইতে বলি না। কিন্তু যাঁহারা সেই স্মৃতির প্রতি সম্ভ্রমযুক্ত হইতে গিয়া তাঁহাদিগের ভুলগুলিকেও অলংকার-বিভূষিত করিতে চাহেন— সে গুলির অনুকরণ করিতে চাহেন, তাঁহাদিগের জন্যই আমার "বাঙালির মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার" প্রবন্ধের অবতারণা।

কুল্লুকভট্ট ও রঘুনন্দনের অপূর্ব পাণ্ডিত্যের প্রশংসা শুনিয়াই যাঁহারা দেশে সেই প্রাচীন টোলের শিক্ষাপ্রণালী সংস্থাপন করিতে চাহেন, নূতনকে একেবারে তাড়াইয়া পুরাতনকে তাহার স্থানে আনিতে চাহেন, তাঁহাদিগের সহিত আমি কখনও একমত হইতে পারি না। নূতন ভারতবর্ষীয় জাতি, নূতন ও পুরাতন উভয়ের সম্মিলনে গঠিত হইবে। অন্ধবিশ্বাস জাতীয় উন্নতির মূল হইতে পারে না। প্রাচীন হিন্দু জাতির মহান আদর্শ ভুলিলে আমাদের চলিবে না, কিন্তু সেই সঙ্গে বর্তমান সময়ে উক্ত আদর্শের অনুকরণ কতটা সম্ভব তাহাও আমাদিগকে ভাবিতে হইবে।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86933